করোনার কারণে থমকে যাওয়া আলোচিত মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মধ্যে মিতু হত্যা, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা, বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা, সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের বরখাস্ত হওয়া উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজনস) পার্থ গোপাল বণিকের ঘুষগ্রহণ ও মানিলন্ডারিং মামলা এবং সাবেক বিচারপতি এস কে সিনহার ৪ কোটি টাকা আত্মসাতসহ আলোচিত বেশ কিছু মামলা রয়েছে। এছাড়া গাড়ি ও স্বর্ণ ব্যবসায়ী মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলায় অভিযোগ গঠন করেছেন আদালত।করোনার কারণে ভার্চুয়াল আদালতে এমন অনেক মামলার জামিন শুনানি হয়েছে। তবে ১৯ আগস্ট থেকে সকল আদালত খোলায় বিচারের স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু হয়েছে।
এসব মামলার পাবলিক প্রসিকিউটর ও আইনজীবীদের থেকে জানা যায়, আলোচিত ঘটনাগুলোর আসামিদের বিরুদ্ধে অনেক মামলারই চার্জশিট দেয়া হয়েছে। এরইমধ্যে এসব মামলার অভিযোগ গঠন এবং বিচারকাজ শুরু হয়েছে।
আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে-
মিতু হত্যা মামলা
২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় মাহমুদা আক্তার মিতুকে প্রকাশ্যে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার তখন চট্টগ্রাম থেকে বদলি হয়ে ঢাকায় ছিলেন। স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের পর চট্টগ্রাম ফিরে তিনি নিজেই পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এবং পুলিশের হেফাজত থেকে মামলার নথিপত্র বিচার বিভাগের হেফাজতে নিতে আবেদন করেছিলেন।
আবেদনের পাঁচ বছর পর মামলাটির নথিপত্র বিচার বিভাগের হেফাজতে থাকবে বলে সোমবার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। হাইকোর্টের সেই নির্দেশ সাড়া দিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মেহনাজ রহমানও একই আদেশ দিয়েছেন বলে বাবুল আক্তারের আইনজীবী শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী জানান।
তিনি বলেন, মামলার নথিপত্র জুডিশিয়াল হেফাজতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের আওতায় থাকবে। চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট যাকে কাস্টডিয়ান (ম্যাজিস্ট্রেট) নির্ধারণ করবেন, তার অধীনে ট্রাঙ্কে সিলগালা করা অবস্থায় এগুলো রাখা হবে।
এদিকে চলতি বছরের মে মাসে স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাবুল নিজেই আসামি বনে যান। এরপর ৪ মাস ধরে কারাগারে রয়েছেন বাবুল। গত ১৮ অগাস্ট ও ১০ অগাস্ট দুই দফায় তার পক্ষে করা জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে আদালত। গত ২৯ মে বাবুল আক্তারকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফেনী কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে তিনি সেখানেই আছেন।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলা
কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার স্বাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। ২৩ আগষ্ট সকাল সোয়া ১০টায় কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে দেশের আলোচিত এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। টানা ৩ দিন এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ করা হবে বলে আদালত সূত্র জানায়।
এদিন নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌসের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্যদিয়ে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন- সিনহার সাবেক সহকর্মী সাহেদুল ইসলাম সিফাত।
কক্সবাজার আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম বলেন, মামলায় স্বাক্ষ্যদানের জন্য ৮৩ জন স্বাক্ষীর মধ্যে প্রথম দফায় ১৫ জনকে উপস্থিত থাকতে ইতিমধ্যে সমন জারি করা হয়েছে।
এর আগে গত ২৬, ২৭ ও ২৮ জুলাই স্বাক্ষ্যদানের দিন ধার্য থাকলেও করোনার কারণে পিছিয়ে যায়। পরে গত ১৬ আগস্ট আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে ২৩, ২৪ ও ২৫ আগস্ট স্বাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করে আদেশ দেন।
গত বছর ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর আবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।
এ ঘটনায় সেই সময় সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় লিয়াকত আলীকে। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে র্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়।
এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় একটি এবং রামু থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করে।
সিনহা নিহতের ৬ দিন পর সাবেক পরির্দশক লিয়াকত আলী ও সাবেক ওসি প্রদীপসহ ৭ পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার অভিযোগে টেকনাফ থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলার তিন স্বাক্ষী এবং শামলাপুর চেকপোস্টে ঘটনার সময় দায়িত্ব পালনকারি আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের (এপিবিএন) তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এক পর্যায়ে পলাতক থাকা অবস্থায় টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
সর্বশেষ গত ২৪ জুন মামলার একমাত্র পলাতক থাকা আসামী টেকনাফ থানার সাবেক এএসআই সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণ করে।
আত্মসমর্পণকারি সাবেক এএসআই সাগর দেব ছাড়া র্যাব ১৪ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালায়। এদের মধ্যে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
তদন্ত শেষে গত বছর ১৩ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তৎকালীন র্যাব ১৫-তে দায়িত্বরত সহকারি পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে আলোচিত হত্যাকান্ড বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় আসামিদের সাফাই সাক্ষী শেষ হয়েছে। যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য আগামী ৭ সেপ্টেম্বর মামলার পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন আদালত।
আদালত সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত মোট ৪ জন সাফাই সাক্ষ্য দেন। গত ২২ আগস্ট আসামি জিয়ন ও রাসেল ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ৩৪০(৩) ধারায় নিজেরাই সাক্ষ্য দেন। এর মধ্যে দিয়ে মামলার সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়।
এর আগে ১৪ মার্চ ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালতে ২২ আসামি আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানিতে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন।
মামলায় মোট ৪৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
এর আগে গত বছরের জানুয়ারিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বিচারের জন্য মামলাটি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বদলির আদেশ দেন। এরপর মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ পাঠানোর আদেশ দেন।
২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামান ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
অভিযোগপত্রে ২৫ জনের মধ্যে এজাহারভুক্ত ১৯ জন এবং এর বাইরে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আরও ৬ জনের জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। এজাহারভুক্ত ১৯ জনের মধ্যে ১৭ জন এবং এজাহারের বাইরে থাকা ৬ জনের মধ্যে ৫ জনসহ মোট ২২ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পলাতক রয়েছেন ৩ জন। অভিযোগপত্রে ৬০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে এবং ২১টি আলামত ও ৮টি জব্দ তালিকা আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।
ডিআইজি প্রিজনস পার্থ গোপাল বণিক
ঘুষগ্রহণ ও মানিলন্ডারিং মামলায় বরখাস্ত সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের বরখাস্ত হওয়া উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজনস) পার্থ গোপাল বণিকের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ২৪ আগস্ট দিন ধার্য করেছেন আদালত।
এর আগে ঘুষগ্রহণ ও মানিলন্ডারিং এর অভিযোগে ২০১৯ সালের ২৮ জুলাই সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত দুদকের সেগুনবাগিচার প্রধান কার্যালয়ে কমিশনের পরিচালক মুহাম্মদ ইউছুফের নেতৃত্বে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় পার্থ গোপাল বণিককে।
পরে ঘুষ ও দুর্নীতির কয়েক লাখ নগদ টাকা তার বাসায় রয়েছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে সেদিন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকেই পার্থ গোপাল বণিকের বাসায় অভিযান চালানো হয়। অভিযানে ওই বাসা থেকে নগদ ৮০ লাখ টাকা জব্দ করা হয় এবং তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এবং দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ দুদকের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধান দলের নেতা মো. সালাউদ্দিন বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
গাড়ি ও স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোল্ডেন মনির
গত বছরের ২০ নভেম্বর গভীর রাত থেকে ২১ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত টানা ৮ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে রাজধানীর বাড্ডায় মনিরের বাড়ি ঘিরে রাখে র্যাব। ওই বাসা থেকে ৬০০ ভরি সোনার গহনা, বিদেশি পিস্তল-গুলি, মদ, ১০টি দেশের বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ও নগদ এক কোটি ৯ লাখ টাকা জব্দ করা হয়। পরে তার বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় ৩টি মামলা করে র্যাব।
এর মধ্যে অস্ত্র মামলায় গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন আদালত। এরই মধ্যে দিয়ে মামলাটির আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু হলো।
গত ২৩ আগস্ট ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েশের আদালতে অভিযোগ গঠন শুনানি হয়। এ সময় আদালতে গোল্ডেন মনির নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আদালতের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন। অভিযোগ গঠন শুনানি হওয়ার পর আদালত এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ৮ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন।
সাবেক বিচারপতি এসকে সিনহা
২০১৯ সালের ১০ জুলাই ঋণ জালিয়াতি এবং ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ৪ কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এ মামলায় এসকে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার ২৪ আগষ্ট মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক বেনজীর আহমেদকে জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। তবে এদিন তার জেরা শেষ হওয়ায় আদালত আসামি পক্ষের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ২৯ আগস্ট দিন ধার্য করে।
এদিকে সোমবার তদন্ত কর্মকর্তার জেরার মধ্য দিয়ে মামলার ২১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
এর আগে, দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বাদি হয়ে কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১ এই এ মামলা দায়ের করেন।
২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর আদালতে এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক বেনজীর আহমেদ।
এবিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) মো. সোহেল রানা বলেন, এসব মামলা ছাড়াও বেশিরভাগ মামলায় এরই মধ্যে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। অনেক মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।